ঢাকা,সোমবার, ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪

করোনাকাল কাটিয়ে আবার শুরু হয়েছে মাতারবাড়ি গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ কাজ

নিউজ ডেস্ক ::  চীন থেকে সরাসরি বড় কনটেইনার জাহাজ মাতারবাড়ি গভীর সমুদ্রন্দরে এসে থামবে ২০২৬ সালে। অপারেশনে যাওয়ার এমন লক্ষ্যমাত্রা নিয়ে কাজ করছে মাতারবাড়ি গভীর সমুদ্র বন্দর নির্মাণ প্রকল্প কর্তৃপক্ষ। তবে এর আগেই ২০২২ সালের আগস্টের মধ্যে একটি কয়লা টার্মিনালও নির্মাণ করারও পরিকল্পনা রয়েছে। মোট ১৭ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে ইতোমধ্যেই শুরু হওয়া সরকারে এই প্রকল্পের নির্মাণ কাজে ১০ হাজার কোটি টাকার বেশি অর্থের জোগান দেবে জাপানি উন্নয়ন সংস্থা জাইকা, নিজস্ব তহবিল থেকে চার হাজার কোটি টাকা জোগান দেবে সরকার এবং তিন হাজার কোটি টাকা দেবে বন্দর কর্তৃপক্ষ।

সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, গত কয়েক বছর ধরে সরকার গভীর সমুদ্রে একটি বন্দর নির্মাণের পরিকল্পনা করে আসছিল। এই পরিকল্পনার অংশ হিসেবে ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসে মহেশখালীর সোনাদিয়ায় একটি গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণের লক্ষ্যে প্রকল্পও গ্রহণ করা হয়। সেসময় ২৫ বছরে ৫৫ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে সোনাদিয়ায় গভীর সমুদ্রবন্দরের পর্যায়ক্রমিক উন্নয়নের পরিকল্পনায় বলা হয়েছিল- সোনাদিয়ায় গভীর সমুদ্রবন্দর হলে ২০২০ সাল নাগাদ সেখানে চট্টগ্রাম বন্দরের তুলনায় ৭৪ গুণ বেশি কনটেইনার ওঠানামা করতে পারবে। এলক্ষ্যে ২০১২ সালের ২ জানুয়ারি মন্ত্রিসভার বৈঠকে ‘সোনাদিয়া গভীর সমুদ্রবন্দর কর্তৃপক্ষ আইন’ এর খসড়ায় নীতিগত অনুমোদন দেওয়া হয়েছিল।

কিন্তু ২০১৪ সলের অগাস্টে সোনাদিয়ায় গভীর সমুদ্র বন্দরের প্রস্তাবিত এলাকার মাত্র ২৫ কিলোমিটার দূরে কক্সবাজার জেলার মহেশখালী উপজেলার মাতারবাড়ি এলাকায় ১৩২০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ কেন্দ্রের জন্য একটি জেটি নির্মাণ করতে গিয়েই সমীক্ষায় ধরা পড়ে যে, এখানেই গভীর সমুদ্র বন্দর করার উপেযোগী। এ থেকেই মাথায় আসে গ্রহণ করা হয় প্রকল্প পরিকল্পনা। চলতি বছরের ১০ মার্চ মাতারবাড়িতে ১৭ হাজার ৭৭৭ কোটি টাকা ব্যয়ে দেশের প্রথম গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ প্রকল্প একনেকের অনুমোদন পায়।

সরকার সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, যেহেতু সোনাদিয়ার নিকটেই মাতারবাড়িতে একটি গভীর সমুদ্র বন্দর হচ্ছে সেক্ষেত্রে আরও কোনও সমুদ্র বন্দরের প্রয়োজন নাই। তাই সোনাদিয়ায় গভীর সমুদ্র বন্দর নির্মাণের প্রকল্পটি বাতিল করা হয়। চলতি ২০২০ সালের ১ সেপ্টেম্বর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে মন্ত্রিসভার ভার্চুয়াল বৈঠকে আট বছর আগের নেওয়া সেই সিদ্ধান্ত বাতিলের প্রস্তাব অনুমোদন দেওয়া হয়। ওইদিন মন্ত্রিসভার ভৈঠক শেষে মন্ত্রিপরিষদ সচিব বলেন, ‘সোনাদিয়া গভীর সমুদ্রবন্দর করার কথা ছিল। কিন্তু পরবর্তী সময়ে সরকার সিদ্ধান্ত নিয়েছে যে সোনাদিয়ায় আর কোনও সমুদ্রবন্দর হবে না। যেহেতু সোনাদিয়ার খুব কাছাকাছি মাতারবাড়িতে একটা সমুদ্রবন্দর নির্মাণ চলছে।’

সরকারের সিদ্ধান্ত ব্যাখ্যা করে মন্ত্রিপরিষদ সচিব জানিয়েছিলেন- সোনাদিয়ায় যদি আবার সমুদ্রবন্দর হয়, তবে আমাদের প্রাকৃতিক বৈচিত্র্যের অনেক ভারসাম্য ক্ষুণ্ন হবে। এটা যখন স্টাডিতে ধরা পড়ল, তখন সরকার সিদ্ধান্ত নিলো সোনাদিয়ায় প্রকৃতির ক্ষতি করে সমুদ্রবন্দর করার দরকার নেই। তাই দীর্ঘ সময় করোনা জটিলতার কারণে গত ফেব্রুয়ারি মাস থেকে মাতারবাড়ি গভীর সমুদ্র বন্দরের নির্মাণ কাজ বন্ধ হয়ে গেলে তা আবার শুরু হয়েছে।

জানা গেছে, মাতারবাড়ি বন্দর নির্মাণ কাজ শতভাগ শেষ হলে চীন থেকে সরাসরি বড় কনটেইনার জাহাজ ভেড়ানো সম্ভব হবে। বর্তমানে চট্টগ্রাম বন্দরে আসা একটি জাহাজে সর্বোচ্চ ১ হাজার ৮৭৮টি কনটেইনার বহন করতে সক্ষম হলেও মাতারবাড়ি গভীর সমুদ্রে ভিড়তে পারবে এর চার গুণ কন্টেইনারবাহী বিশাল জাহাজ। বন্দর সুবিধা অনুযায়ী ১৪ থেকে ১৫ হাজার একক কনটেইনারবাহী জাহাজ ভেড়ানো যাবে। নৌ পরিবহন মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে নেওয়া প্রকল্পটি চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ এবং সড়ক ও জনপথ বিভাগ বাস্তবায়ন করছে। এর ডিজাইন ও লে-আউটসহ সব নকশা জাপানি বিশেষজ্ঞদের তত্ত্বাবধানে করা হচ্ছে। এই প্রকল্পের অধীনে সংযোগ সড়কসহ গভীর সমুদ্র বন্দরে ৩০০ ও ৪৬০ মিটার দীর্ঘ দুটি টার্মিনাল নির্মাণ করা হবে।

উল্লেখ্য, সীমিত জনবল এবং যন্ত্রপাতি দিয়ে চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দরকে বছরে ৩০ লাখের বেশি কন্টেইনার হ্যান্ডলিং করতে হচ্ছে। এসময়ে দেশের অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক কর্মকাণ্ড প্রসারিত হয়েছে। এ অবস্থায় ভবিষ্যতে জাহাজ ও কন্টেইনারের সংখ্যাও বাড়লে চট্টগ্রাম বন্দরের পক্ষে সেই পরিস্থিতি সামাল দেওয়া কঠিন হবে। বিধায় একটি গভীর সমুদ্র বন্দর নির্মাণ জরুরি হয়ে পড়ে। আর গভীর সমুদ্র বন্দরের জন্য প্রথম পছন্দের তালিকায় ছিলো মাতারবাড়ির নাম।

উইকিপিডিয়ার তথ্য মতে জানা গেছে, মাতারবাড়ি বন্দর হলো বাংলাদেশের চট্টগ্রাম বিভাগের, কক্সবাজার জেলার, মাতারবাড়ি এলাকার প্রস্তাবিত গভীর সমুদ্র বন্দর। কক্সবাজার জেলার মহেশখালীতে বিদ্যুৎ কেন্দ্রের জন্য আনা কয়লাবাহী জাহাজ ভেড়ানো জেটিকে সম্প্রসারণ করে পূর্ণাঙ্গ বাণিজ্যিক বন্দর হিসাবে নির্মাণ করা হবে। এই বন্দরে অন্তত ১৫ মিটার গভীরতা বা ড্রাফটের জাহাজ অনায়াসে এর চ্যানেলে প্রবেশ করতে পারবে। মাতারবাড়ি বন্দরের গভীরতা ১৬ মিটার হওয়ায় প্রতিটি জাহাজ ৮ হাজারের বেশি কন্টেইনার আনতে পারবে। বর্তমানে ৯ মিটারের চেয়েও কম গভীরতার জাহাজ দেশের দুটি সমুদ্রবন্দর চট্টগ্রাম এবং মোংলায় প্রবেশ করতে পারে। মাতারবাড়ি বন্দর স্থাপনের কাজে প্রায় ১৪ দশমিক ৩ কিলোমিটার দীর্ঘ একটি নৌ-চ্যানেল তৈরি করছে জাইকা। প্রধান ন্যাভিগেশনাল চ্যানেল ৩৫০ মিটার প্রশস্ত। সেই সঙ্গে বন্দরের অর্থায়নে নির্মাণ করা হবে ১০০ মিটার দীর্ঘ জেটি।

জানা গেছে, মাতারবাড়ি বন্দর নির্মাণের প্রাথমিক পরিকল্পনায় প্রথম ধাপে থাকবে দুটি টার্মিনাল। একটি সাধারণ পণ্যবাহী জাহাজ ভেড়ানোর জন্য টার্মিনাল এবং অপরটি হবে কনটেইনার টার্মিনাল। যেখানে বড় জাহাজ (মাদার ভ্যাসেল) ভিড়তে পারবে, যেটি এখন বাংলাদেশের কোনও বন্দর জেটিতে ভিড়তে পারে না। নির্মাণের প্রথম পর্যায়ে কন্টেইনার টার্মিনালটি ১৮ হেক্টর জমিতে নির্মিত হবে এবং ৪৬০ মিটার দীর্ঘ বার্থ থাকবে। এটি ৮ হাজার টিইইউ জাহাজ ধারণ করতে সক্ষম হবে এবং এর বার্ষিক ক্ষমতা ৬ লাখ থেকে ১ দশমিক ১ মিলিয়ন টিইইউ হবে।

পরবর্তীতে কনটেইনার টার্মিনালটি আরও প্রসারিত হবে ৭০ হেক্টর জমিতে, এই পর্যায়ে একটি ১ হাজার ৮৫০মিটার বার্থ থাকবে, এবং এর বার্ষিক ক্ষমতা হবে ২ দশমিক ৮ মিলিয়ন টন। প্রথম ধাপে বন্দর ও পণ্য পরিবহনের জন্য সড়কে নির্মাণসহ খরচ ধরা হয়েছে ১৭ হাজার ৭৭৭ কোটি টাকা। ২০২৬ সালে এ প্রকল্পের প্রথম ধাপের কাজ শেষ হবে। দ্বিতীয় ধাপে নির্মিত হবে তিনটি কনটেইনার টার্মিনাল। এভাবে পর্যায়ক্রমে বাড়ানো হবে টার্মিনাল।

জানা গেছে, ১৬ মিটার গভীর এই চ্যানেলে যে কোনও সাইজের জাহাজ প্রবেশ করানো এবং যে কোনও সাইজের জাহাজ বন্দরে ভেড়ানোর জন্য প্রায় ১৫ কিলোমিটার এলাকা ড্রেজিং করে তৈরি করা হয়েছে দুই কিলোমিটার দীর্ঘ নতুন চ্যানেল। করোনাকালীন জটিলতা কাটিয়ে সাগরে বাঁধ দিয়ে নতুন চ্যানেল তৈরির মাধ্যমে আবার শুরু হয়েছে মহেশখালী মাতারবাড়ি গভীর সমুদ্র বন্দর নির্মাণের কাজ।

এদিকে মাতারবাড়ি গভীর সমুদ্র বন্দর সম্পর্কে চট্টগ্রামের ব্যবসায়ী চট্টগ্রাম চেম্বারের সদস্য কামরুল ইসলাম জানিয়েছে, মাতারবাড়িতে গভীর সমুদ্র বন্দর নিমাণের পাশাপাশি পণ্য ও কন্টেইনার পরিবহন সহজ ও দ্রুত করতে সড়ক ও রেলপথ নির্মাণ জরুরি। কারন ক্রমশ বন্দরের ওপর চাপ বাড়বে।

এ প্রকল্প সম্পর্কে জানতে চাইলে পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান জানিয়েছেন, এটি সরকারের একটি মেগা প্রকল্প। সোনাদিয়া গভীর সমুদ্র বন্দরের গুরুত্ব নিয়েই এটি নির্মিত হচ্ছে। এই বন্দরটি নির্মিত হলে চট্টগ্রাম সমুদ্র বন্দরের ওপর থেকে চাপ কমবে। এই বন্দরে বেশি সংখ্যক কন্টেইনারবাহী বড় জাহাজ ভেড়ার সক্ষমতা থাকায় দেশের অর্থনীতি দ্রুতগতিতে সমৃদ্ধ হবে। পরিকল্পনামন্ত্রী জানিয়েছেন, প্রকল্পটি ইতোমধ্যেই ডিপিপি অুমোদন পেয়েছে।

পাঠকের মতামত: